ভারতীয় সংবিধানের ১৩টি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য || Salient Features Of The Constitution Of India
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুসারে ভারতীয় গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এই গণপরিষদের পঞ্চম পরিবেশন ১৯৪৭ সালের ২৯শে আগস্ট সাত জন সদস্য বিশিষ্ট এবং ডঃ বি আর আম্বেদকরের সভাপতিত্বে খসড়া কমিটি বা ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয়। খসড়া কমিটি দীর্ঘ সময় নিয়ে ভারতীয় সংবিধান রচনা করে। ভারতীয় সংবিধান রচনা করতে কমিটির সময় লেগেছিল দুই বছর ১১ মাস ১৮ দিন বা বলতে গেলে প্রায় তিন বছর। ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর দীর্ঘ সময় নিয়ে বিভিন্ন দেশের সংবিধান পড়ে, বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে ভালো ভালো উপাদান সংগ্রহ করে তা ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত করেন। ফলে ভারতীয় সংবিধানের একাধিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য || Salient Features Of The Constitution Of India
প্রথমত ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব
ভারতীয় সংবিধানের প্রথম এবং উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে- ভারতীয় সংবিধানের প্রচুর পরিমাণে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় সংবিধান প্রণেতারা অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয়েছিলেন ঠিক সেরকমই প্রভাবিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলে পাশ হওয়া বিভিন্ন সাংবিধানিক আইনের দ্বারা। এর মধ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দুই তৃতীয়াংশ আংশকেই সংবিধান প্রণেতারা নতুন সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত ; প্রস্তাবনার উপস্থিতি
ভারতীয় সংবিধানের আরেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানের শুরুতেই একটি প্রস্তাবনা রয়েছে। প্রস্তাবনাকে সংবিধানের মুখবন্ধ বলা হয়। এতে সংবিধানের নৈতিক আদর্শ, দর্শন, মূল উদ্দেশ্য প্রভৃতি ব্যক্ত করা হয়েছে। বইয়ের ভুমিকা যেমন সমগ্র বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অগ্রিম ধারণা দেয়,ঠিক সেরকমই সংবিধানের প্রস্তাবনাও আমাদের সমগ্র সংবিধান সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম,সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ,;গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।।
তৃতীয়ত : সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন
ভারতীয় সংবিধানের এক অন্যতম এবং উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল- ভারতের সংবিধানই হলো সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের ঊর্ধ্বে কোনো আইন হতে পারেনা। সকল ক্ষমতা এবং নাগরিকদের সকল অধিকারের উৎসই হল সংবিধান। পার্লামেন্ট সংবিধান বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। সংবিধান বিরোধী কোন আইন প্রণীত হলে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করবে।।
বিশেষ ঘোষণা ;
যারা NBU'র সঙ্গে যুক্ত কোনো একটা কলেজে Major Political Science নিয়ে পড়াশোনা করছো, তোমরা যদি 2nd Semester Major Political Science Syllabus-এর সমস্ত ইউনিটের প্রশ্ন উওরের PDF Note নিতে চাও, তাহলে আজই- +918388986727 নম্বরে যোগাযোগ করো।
চতুর্থ : পৃথিবীর বৃহত্তর লিখিত সংবিধান
ভারতীয় সংবিধানে- প্রচুর সংখ্যক ধারা এবং উপধারা যুক্ত হওয়ায় ভারতীয় সংবিধান বর্তমানে হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। সংবিধান গ্রহণ করার সময় ভারতীয় সংবিধানে মোট ৩৯৫ টি ধারা এবং আটটি তফসিল ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের ৪৪৮ টির বেশি ধারা ১২ টি তফসীল এবং ২৫ টি পার্ট রয়েছে।
পঞ্চম : সুপরিবর্তনীয় এবং দুষপরিবর্তনীয় সংবিধানের সমন্বয়
ভারতীয় সংবিধান একদিকে যেমন ব্রিটেনের সংবিধানের মতো পুরোপুরিভাবে সুপরিবর্তনীয় নয়, ঠিক সেরকমই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মতো দুষ্পরিবর্তনীয়ও নয়। ভারতীয় সংবিধান হলো এই দুইয়ের মাঝামাঝি। মৌলিক অধিকার,নির্দেশমূলক নীতি প্রভৃতির পরিবর্তনে সংসদের মোট সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের, উপস্থিত এবং ভোটদানকারী সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। আবার সংবিধানে এমনও বেশ কিছু জায়গা আছে যেগুলো পরিবর্তন করতে হলে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় আইনসভা নয়, পাশাপাশি ও থেকে বেশি অঙ্গরাজ্যের আইনসভা কর্তৃক অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ফলে তা অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে।
ষষ্ঠত ; লিখিত এবং অলিখিত সংবিধানের সংমিশ্রণ
এটা যেমন স্বীকার করতেই হয় যে ভারতের সংবিধান পৃথিবীর বৃহত্তর লিখিত সংবিধান, ঠিক সেরকমই আবার এটাও অস্বীকার করা যায় না যে ভারতীয় সংবিধানে এমন বেশ কিছু জিনিস রয়েছে যেটা অলিখিত অবস্থায় রয়ে গেছে। উদাহরণ হিসাবে- যদি কোনো বিষয়ে লোকসভায় ভোটে সরকারপক্ষ পরাজয় ঘটে,তাহলে মন্ত্রীসভার পদত্যাগ করা উচিত কিনা-সেটা ভারতীয় সংবিধানে লেখা নেই।
সপ্তম ; ভারত হল রাজ্যসমূহের সমবায়
ভারতীয় সংবিধানের ১ নং নম্বর ধারায় বলা হয়েছে " India That Is Bharat - shall be the Union Of States. অর্থাৎ সংবিধানে ভারতকে রাজ্য সমূহের সমবায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অঙ্গরাজ্য গুলির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে গঠিত হয়নি এবং অঙ্গরাজ্য গুলির ভারত ত্যাগের কোনো প্রশ্ন ওঠেনা, সেই কারণে একে রাজ্য সমূহের সমবায় বলা হয়েছে।
অষ্টম : ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতক একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের সংবিধান যখন কার্যকর হয় তখন কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি উল্লেখ করা ছিল না। ১৯৭৬ সালের ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত করার মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে যে ভারত কখনই কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের পক্ষপাতিত্ব করবেনা।
নবম ; মৌলিক অধিকার এবং মৌলিক কর্তব্য
নাগরিকদের ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গিক বিকাশের জন্য সংবিধানের পার্ট III-তে এবং ১২ থেকে ৩৫ নং ধারায় একদিকে যেমন ছয় ধরনের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে,ঠিক সেরকমই রাষ্ট্রের প্রতি কিছু দায়িত্ব পালন করার জন্য PART IV,Article 51(A) নাগরিকদের ১১ ধরনের মৌলিক কর্তব্য পালনের কথাও বলা হয়েছে।
দশম ; নির্দেশমূলক নীতির উল্লেখ
সংবিধানে শুধুমাত্র নাগরিকদেরকেই দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে বলা হয়নি। সংবিধানে নির্দেশমূলক নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালকদেরকেও দেশের কল্যাণের জন্য কিছু নীতির অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। ভারতকে একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করতে,;ভারতীয়দের সামাজিক, রাজনৈতিক ন্যায়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুবিধা গুলো প্রদান করতে সংবিধান প্রণেতাদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালকদের জন্য সংবিধানের পার্ট IV- ৩৬ থেকে ৫১ নং ধারায় 4 প্রকার- সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত নির্দেশমূলক নীতি ; শাসন কাঠামো সংক্রান্ত ; শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত নির্দেশমূলক নীতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র সম্পর্কিত- নির্দেশমূলক নীতি যুক্ত করেছিলেন।
একাদশ স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার
ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে আইন বিভাগ এবং শাসন বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখার জন্য এবং বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্য সংবিধানে বিচার বিভাগকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যেমন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে কোনো প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা না থাকা, একমাত্র প্রমাণিত অসদাচরণ এবং অক্ষমতার কারণ ছাড়া তাদের পদচ্যুত না করতে পারে ইত্যাদি।
দ্বাদশ সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার
ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় ভারতের জনগণের হাতে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভারতের মূল সংবিধানে ৩২৬ নম্বর ধারায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে ভোট অধিকার দেওয়া হয়েছে। এক ব্যক্তির এক ভোট এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে সংবিধানে। ১৯৮৯ সালের আগে পর্যন্ত ২১ বছর বয়স্ক সকলকেই ভোটাধিকার দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৮৯ সালের ৬১ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভোটাধিকারের বয়সসীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ তে নিয়ে আসা হয়।
ত্রয়োদশ ; নাগরিকদের এক নাগরিকত্বের ব্যবস্থা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,;কানাডা বা সুইজারল্যান্ডের মত রাষ্ট্রে নাগরিকদের দ্বি-নাগরিকত্বের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ভারতের সেই নীতি অনুসরণ করা হয়নি। ভারতীয় ক্ষেত্রে কোনো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে তার পৃথক নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না। তার একটাই পরিচয় থাকবে এবং সেটা হচ্ছে সে ভারতীয় নাগরিক।।
তবে এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছাড়া ভারতের সংবিধানে আরো একাধিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-
▪ প্রথমত ভারতীয় সংবিধানের পার্ট ফাইভ আর্টিকেল ৭৯ থেকে ১২২'র মধ্যে কেন্দ্রে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উল্লেখ,
▪ দ্বিতীয়তঃ সংসদীয় শাসন ব্যবসার উল্লেখ;
▪ তৃতীয়ত ; যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার উল্লেখ ;
▪ চতুর্থ ; জরুরী কালীন অবস্থা সংক্রান্ত শাসনব্যবস্থার উল্লেখ ইত্যাদি
ভারতের সংবিধান সম্পর্কিত সচর আচর জিজ্ঞাসিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
- খসড়া কমিটি বা ড্রাফটিং কমিটি কবে গঠিত হয়েছিল?
- খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান কে ছিলেন?
- ভারতীয় সংবিধান তৈরি করতে কতদিন সময় লেগেছিল?
- ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হওয়ার সময় কয়টি ধারা ছিল?
- বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানে মোট কয়টি ধারা রয়েছে?
- কোন দেশের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা যুক্ত করা হয়েছে?
- ভারতীয় সংবিধানের ১ নম্বর ধারায় কী বলা হয়েছে?
- ভারতীয় সংবিধানে কবে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছিল?
- সংবিধানের কত নম্বর ধারায় মৌলিক অধিকার রয়েছে?
- সংবিধানের কত নম্বর ধারায় মৌলিক কর্তব্য যুক্ত করা হয়েছে?
- সংবিধানে কত নম্বর ধারায় নির্দেশ মূলক নীতি রয়েছে?
- সংবিধানের কত নম্বর ধারায় ভারতীয় নাগরিকদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে?
- কবে নাগরিকদের ভোটদানের বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ করা হয়?
** এই সম্পর্কে জানুন👉 : গণপরিষদ গঠনের, উদ্দেশ্য এবং কার্যাবলী
*** এই সম্পর্কে পড়তে পারেন : সরকারি গাণিতিক কমিটির উপর নোট
*** আরও জানুন ; নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যের উপর সেরা নোট
** এটাও পড়ে দেখুন ; নিজের ভালোর জন্যেই জেনে রাখুন সাইবার ক্রাইম এবং ইনফরমেশন & টেকনোলজি অ্যাক্ট সম্পর্কে
*** এটাও পড়ে দেখুন ; কিভাবে থানায় একটি F.I.R লিখতে হয়??
_____________________________________________
*** যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন নিম্নলিখিত উপায়ে।