Introduction ; রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। একদিকে রয়েছে সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি এবং অপর দিকে রয়েছে আধুনিক বা অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। সেই সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির একটি রূপই হলো নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
নীতি মানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ, উদ্ভব এবং সমর্থক ;
▪ ইংরেজি Norm কথার অর্থ হল আদর্শ। অপরদিকে Approach বা দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ হলো কোনো কিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনের পদ্ধতি বা ধারা। সুতরাং Normative Approach হলো সেই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
▪ এই নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে প্লেটোর সময়কালে। প্লেটোর সময়কাল থেকে উনিশ শতকের শেষ কা' পর্যন্ত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এই নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
▪ নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকদের মধ্যে প্রাচীনকালে ছিলেন প্লেটো অ্যারিস্টোটল, মধ্যযুগে ছিলেন অগাস্টিন, অ্যাকুইনাস এবং আধুনিককালে ছিলেন টমাস ম্যাকিয়াভেলি, জন লক, টমাস হবস, রুশো, কান্ট, হেগেল, গ্রীন প্রমুখ।
▪ নীতিমানবাচক বা আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞা ;;
রাষ্ট্র রাজনীতি সম্পর্কিত বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্র দার্শনিক এবং রাষ্ট্র চিন্তাবিদরা বাস্তব ঘটনার অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার পরিবর্তে ভালো-মন্দ,উচিত-অনুচিত, কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত, নীতি আদর্শ প্রভৃতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাখা করেন, তখন তাই হয় নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
নীতি মান বাচক দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য || Characteristics Of Normative Approach
নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়। যেমন-
▪ প্রথমত | নীতি-আদর্শের উপর গুরুত্ব ;
নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ভারনন ভ্যানডাইক বলেছেন, নীতিবানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হল সেই দৃষ্টিভঙ্গি -'যা কী আছে (What Is) এর পরিবর্তে কী হওয়া উচিত (What ought to be or should be)- তা নিয়েই বেশি আলোচনা করে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন উচিৎ হওয়া উচিত,কী হলে জনগণের ভালো হবে? কিভাবে হবে- এই বিষয়গুলোই নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা আলোচনা করেছেন।
▪ দ্বিতীয়ত | মূল্যবোধের উপর অধিক গুরুত্ব;
নীতিমান দৃষ্টিভঙ্গির অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল-এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যবোধের উপর অধিক গুরুত্ব দান করা হয়েছে। নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাদের মতে রাজনৈতিক আলোচনা কখনোই মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। তাই এর প্রবক্তারা রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ভালো মন্দ,উচিত-অনুচিত, কাঙ্খিত-অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভৃতি মূল্যবোধের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।।
▪ তৃতীয়ত | অবরোধ পদ্ধতি অনুসরণ ;
নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা রাষ্ট্র-রাজনীতির বিশ্লেষণে অবরোহ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তারা কোনো বাস্তব রাজনৈতিক ঘটনার অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণের পরিবর্তে তারা সেখানে পূর্ব অনুমান বা পূর্ব সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে নিজেদের বক্তব্যকে উপস্থাপন করেছেন।
▪ চতুর্থ : কল্পণা প্রসুত ;
নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে- এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত কল্পনাপ্রসূত। এর প্রবক্তার নিজেদের কল্পনা বা পূর্ব অনুমানের ভিত্তিতেই কথা বলছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তার বাস্তব জীবনের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর ভিত্তি করে নিজের বক্তব্য পেশ করেননি।
▪ পঞ্চমত | প্রকৃতিগতভাবে নির্দেশাত্মক ;
নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো-এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিগতভাবে নির্দেশাত্মক (Prescriptive). এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা কোনটি ঠিক বা কোনটা উচিত তা নির্দেশ করে। দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা সেইসব নিয়ম বা সূত্র নিয়ে আলোশোনা করেছেন যেগুলো মনুষ্য সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট,প্রযুক্ত এবং পরিবর্তনযোগ্য।
নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা (Criticism Of Normative Approach) ;
প্রাচীনকাল থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত নীতিবানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট গুরুত্ব থাকলেও আধুনিককালে অভিজ্ঞতাবাদীরা, বিশেষ করে আচরণবাদীরা নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি বের করেন। ফলে নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা বিভিন্নভাবে হতে থাকে। যেভাবে নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা হয়ে থাকে, তা হলো-
▪ প্রথমত, অবাস্তব ; নীতিমান বাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা বাস্তব জীবনের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ওপর গুরুত্ব না দিয়ে তারা সেখানে কল্পনা,অনুমানের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি বলে সমালোচনা করা হয়।
▪ দ্বিতীয়ত ; অবৈজ্ঞানিক ; আচরণবাদীরা মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান যদি রাষ্ট্র বিজ্ঞান, একটা বিজ্ঞান হয়ে থাকে তাহলে এর আলোচনাও অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। কিন্তু নীতিমানমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধ যুক্ত হওয়ায়,সেখানে কল্পনা, অনুমানের অধিক গুরুত্ব থাকায় এবং যেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা না থাকায় তা অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিণত হয়েছে।
▪ তৃতীয়তঃ অনৈতিহাসিক ; নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা ইতিহাসকে এড়িয়ে গেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ইতিহাসের তুলনায় দর্শনের অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
▪ পদ্ধতি গত ত্রুটি ; এছাড়াও নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এর প্রবক্তারা পূর্ব অনুমান বা পূর্ব সিদ্ধান্তের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন তাই এর সাথে বাস্তবের কোন সম্পর্ক থাকেনা। অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে একমাত্র আরোহী পদ্ধতি অনুসরণ করে যে তত্ত্ব গড়ে তোলা হয় তাই একমাত্র বাস্তবসম্মত হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির পদ্ধতি গত ত্রুটি আছে বলে সমালোচনা করা হয়।।
▪ গুরুত্ব ; তবে নানা দিক থেকে নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গের সমালোচনা করা হলেও নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব যে একেবারেই নেই বা একেবারেই হারিয়ে গেছে সেটা কিন্তু নয়। কারণ প্রাচীনকাল থেকে প্লেটো থেকে শুরু করে আধুনিক কালে টমাস নিকালো ম্যাকিয়াভেলি এবং নয়া উদারনীতিবাদীরাও কিন্তু নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্য নিয়ে রাষ্ট্রের বিচার বিশ্লেষণ করেন।।
এটাও পড়ো👉 ; সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক
আরও পড়ো👉 : রাষ্ট্রের কিছু সহজ সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্য
এটা পড়ো👉 : রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের 6টি উল্লেখযোগ্য প্রয়োজনীতা
এটাও পড়ো👉 : রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিবর্তনমূলক বা ঐতিহাসিক মতবাদ