চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল কী ছিল?

Ajit Rajbanshi
0

 

wb-class-12-history-causes-and-effects-of-permanent-settlement



প্রশ্নঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? 

ভূমিকাঃ ভারতের প্রথম গভর্নর ওয়ারেন হস্টিংস প্রবর্তিত পাঁচশালা বন্দোবস্ত এবং একসালা বন্দোবস্ত এর বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকার ফলে সেগুলো বাতিল করা হয়েছিল। এরপর ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের পিটের ভারত শাসন আইনে জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের কথা বলা হয় এই উদ্দেশ্যে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে আসেন এবং তিনি নতুনভাবে ভূমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেন। 


চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনঃ- 

লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে আলোচনা শুরু করলে স্যার জন শোর তাকে জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ীভাবে জমি বন্দোবস্ত করার কথা বলেন। তার কথার গুরুত্ব দিয়ে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের বাংলা এবং বিহার এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার জমিদারদের ১০ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এই ব্যবস্থা ইতিহাসে দশসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে বাংলা বিহার এবং উড়িষ্যার জমিদারদের ১০ বছরের জমিদারি প্রদান করা হয়। এরপর বলা হয় যে, পরিচালক সভা যদি অনুমোদন দেয়, তাহলে এই দশ বছরের ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত করা হবে। এরপর ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে অনুমোদন পাওয়া গেলে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে মার্চ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রুপান্তরিত করেন।।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কী বলা হয়েছিল?

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে মার্চ প্রবর্তিত কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ঘোষনা করা হয় যে-

• জমিদারদের বংশানুক্রমিকভাবে স্থায়ীভাবে জমিদারি প্রদান করা হয়।

• চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের একটি নির্দিষ্ট হারে সরকারকে রাজস্ব প্রদান নির্ধারণ করা হয়। 

• জমিদারদের আদায় করা রাজস্বের ৯০% সরকার এবং ১০% জমিদারদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

• এছাড়াও খরা, বন্যা,মহামারী এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা অপ্রাকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্ব মুকুট না করার কথা ঘোষণা করা হয়।।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল এবং কুফল বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফলঃ- 

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূলত দুই ধরনের ফলাফল ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল এর মধ্যে এর সুফল থেকে কূফল ই বেশি লক্ষ্য করা যায়। যেমন- মার্সম্যানের মতে, “এটি (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) ছিল একটি দৃঢ়, সাহসিকতাপূর্ণ ও এবং বিচক্ষণ পদক্ষেপ। 

[I] সুনির্দিষ্ট আয়:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয় এবং সরকারের প্রাপ্য রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। এর ফলে সরকারের বার্ষিক বাজেটের অনেক সুবিধা হয়।

[ii] উৎখাতের আশঙ্কার অবসান:- রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকদেরও সুবিধা হয়। তারা ইজারাদারদের শোষণ এবং ঘনঘন জমি থেে উৎঘাতের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়।

[iii] কৃষির উন্নতি:- জমির ওপর জমিদারের স্বত্ব বা অধিকার সুনিশ্চিত হওয়ায় তারা জমি ও কৃষির উন্নতিতে যত্নবান হন। 

[iv] অনুগত জমিদার শ্রেণির উদ্ভব:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সরকারের অনুগত একটি জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। তাদের সমর্থনে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়। 


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কুফল বা প্রভাব 

ঐতিহাসিক হোমস্ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে একটি দুঃখজনক ভুল বলে অভিহিত করেছেন।

থর্নটন বলেন যে, চ্যাম অল্পতা থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল অপেক্ষা কুফলই বেশি ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই বন্দোবস্তের বিভিন্ন কুফলগুলি উল্লেখ করেন। যেমন— 

[i]কৃষকদের উচ্ছেদ:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারকে জমির স্থায়ী মালিকানা দেওয়া হলেও জমিতে কৃষকের কোনো অধিকার ছিল না। ফলে জমিদার বেশি রাজস্ব পাওয়ার আশায় চাষিকে ঘনঘন জমি থেকে উৎখাত করত। চাষির রাজস্ব বাকি পড়লে জমিদার সেই চাষির জিনিসপত্র নিলাম করত। এজন্য পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা জমিদারের ভাড়াটে মজুরে পরিণত হয়।

[ii] জমির উন্নতি ব্যাহত:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমি ও কৃষির উন্নতি সম্ভব হয়েছিল বলে কেউ কেউ মনে করলেও অনেকে মনে করেন যে এই ব্যবস্থার দ্বারা চাষিরা জমির মালিকানা না পাওয়ায় তারা জমির উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করত না। জমিদাররাও জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, কৃষির প্রসার, সেচের প্রসার, পতিত জমি উদ্ধার প্রভৃতির জন্য অর্থ ব্যয় না করে নিজেদের বিলাসব্যসনেই অর্থ ব্যয় করত। 

[iii] সরকারের লোকসান:- জমিদাররা সরকারকে যে পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ রাজস্ব তারা চাষিদের কাছ থেকে আদায় করত। সরকারের রাজস্ব নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে রাজস্ব থেকে সরকারের আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া জনসংখ্যাবৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পতিত জমি উদ্ধার প্রভৃতি থেকে জমিদারের আয় বহুগুণ বাড়লেও এই বাড়তি আয়ের কোনো অংশ সরকার পেত না.

[iv] কৃষকের দুরবস্থা:- জমিদাররা কৃষকদের ওপর প্রবল অত্যাচার চালিয়ে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করার ফলে কৃষকদের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে ওঠে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদাররা সরকারকে ৩৫ লক্ষ পাউন্ড রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ওই বছর জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ আদায় করেন ১ কোটি ৩৫ লক্ষ পাউন্ড। ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই রামমোহন রায়, লালবিহারী দে, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়তের দুর্দশার কথা সবার সামনে তুলে ধরেন 

[v] পুরোনো জমিদারদের উচ্ছেদ:-এই ব্যবস্থায় 'সূর্যাস্ত আইন' অনুসারে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারি কোশাগারে রাজস্ব জমা দিতে না পারায় পুরোনো বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার প্রথম কুড়ি বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক প্রাচীন জমিদার পরিবার তাঁদের জমিদারি হারান 

[vi] নতুন জমিদারের উত্থান:- পুরোনো বহু জমিদার তাঁদের জমিদারি হারালে শহুরে ধনী বণিকরা নিলামে এই জমিদারিগুলি কিনে নেন। এসব ভূঁইফোঁড় নতুন জমিদাররা শহরে বসে তাঁদের নায়েব-গোমস্তাদের দিয়ে জমিদারি চালাতেন। তাঁদের গ্রামের কৃষক বা জমির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক বা প্রজাকল্যাণের কোনো ইচ্ছা ছিল না। প্রজাদের শোষণ করে প্রচুর অর্থ উপার্জনই ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য।

[vii] কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষতি:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে দ্রুত বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় বহু শহুরে মানুষ ব্যাবসাবাণিজ্য ছেড়ে জমিদারি ক্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কুটিরশিল্পের কাজেও লোকের আগ্রহ কমে যায়। বেশিরভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে। এভাবে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য – সবকিছূই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলার কৃষকদের দুরবস্থার জন্য রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর বাংলার কৃষক' গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তবেই দায়ী করেছেন।

উপসংহারঃ- সুতরাং পরিশেষে বলা যায়, ওয়ারেন হেস্টিংসের মত লর্ড কর্নওয়ালিসও কোম্পানি লাভের উদ্দেশ্যেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছিলেন। এবং ঠিক একইভাবে ওয়ারেন হেস্টিংসের এবং পাঁচশালা এবং একশালা বন্দোবস্তের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও ভারতের কৃষক শ্রেণীর,  কৃষি ব্যবস্থার অগ্রগতি এবং ভারতীয় পুরনো জমিদারদের থেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। 


Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)